নিজস্ব প্রতিবেদক>>> সিলেটের রিজেন্ট পার্ক এন্ড রিসোর্টে বেড়াতে যাওয়া ৮ তরুণ-তরুনীকে আটকে বিয়ে দেয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। স্থানীয় কিছু বাসিন্দা রির্সোটে হামলা চালিয়ে এই তরুণ-তরুণীদের আটকে রেখে বিয়ে দেন। এসময় পুলিশও উপস্থিত ছিলো বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও পুলিশ তা অস্বীকার করছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোববার দুপুরে সিলেটের দক্ষিন সুরমার সিলাম এলাকার রিজেন্ট পার্ক এন্ড রিসোর্টে হামলা চালায় স্থানীয় কিছু লোক। এসময় তারা রিসোর্টে ভাংচুরও অগ্নিসংযোগ করে। রিসোর্টের বিভিন্ন কক্ষে অবস্থান করা ১৬ তরুণ-তরুণীকে আটক করে তারা। পরে কাজী ডেকে এনে তাদের মধ্যে ৮ জনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।
এভাবে আটকে বিয়ে দেয়ার ঘটনায় আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়েছে উল্লেখ করে সিলেট মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি শিরিন আক্তার সোমবার বলেন, এটা খুবই বাজে কাজ হয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক তরুন-তরুণ নিজেদের ইচ্ছায় ঘুরতে যেতেই পারে। ঘুরতে গিয়ে তারা যদি কোন খারাপ কাজ বা অসামাজিক কাজ করে থাকে তবে পুলিশ তাদের ধরে এনে আদালতে প্রেরণ করবে। কিন্তু তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া খুবই খারাপ। এলাকাবাসীকে এই অধিকার কে দিয়েছে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এই রিসোর্ট থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন। এছাড়া পুলিশকেও চাঁদা দিতে হতো। ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর বিএনপির একাধিক গ্রুপ রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চাঁদা দাবি করছে। দাবিকৃত চাঁদা না পেয়ে তাদেরই একটি গ্রুপ স্থানীয় জনতাকে উসকে রোববারের হামলা চালায় বলে জানা গেছে।
আট তরুণ-তরুণীর বিয়ে পড়ান সিলাম ইউনিয়নের কাজী আব্দুল বারী। তিনি বলেন, এলাকাবাসী ছেলেমেয়েদের আটক করে আমাকে খবর দেন। আমি এসে এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে চার ছেলে ও চার মেয়ের বিয়ে পড়াই। এসময় তাদের অভিভাবকরাও উপস্থিত ছিলেন। তিনটি বিয়ের দেনমোহর ১০ লাখ; আরেকটির দেনমোহর ১২ লাখ টাকা।
কাজী বলেন, বিয়ের সময় স্থানীয় কয়েকজন বিএনপি নেতাও উপস্থিত ছিলেন বলে।
রিসোর্টে হামলা ও তরুণ-তরুনীদের বিয়ে পড়ানোর সময় উপস্থিত ছিলেন ঘটনাস্থলে থাকা জাতীয়তাবাদী কৃষকদল সিলেট জেলার সদস্যসচিব তাজরুল ইসলাম তাজুল। তিনি সিলাম এলাকার বাসিন্দা।
ঘটনা সম্পর্কে তাজুল বলেন, অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে ছেলেমেয়েদের আটকের পর তাদের অভিভাবকদের খবর দেয়া হয়। পরে অভিভাবক ও ছেলেমেয়েদের সম্মতিতেই ৮ জনের বিয়ে পড়ানো হয়। বাকি ৮ জনের অভিভাবক পরে সামাজিকভাবে বিয়ের আয়োজন করার প্রতিশ্রুতি দিলে পুলিশ মুছলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়। বিয়ের ব্যাপারে কাউকে জোর করা হয়নি।
চাঁদা দাবির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এরকম কিছু আমি শুনিনি। তবে এই রির্সোটে অসামাজিক কার্যকলাপ নিয়ে এলাকাবাসী অনেকদিন থেকেই বিরক্ত।
তাজুল বলেন, অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ শুনে রোববার রিসোর্টে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। আমরা চেষ্টা করেছি, যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। এজন্য রিসোর্টের গেইট বন্ধ করেছিলাম। কিন্তু অনেকে দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করেন। এসময় রিসোর্টে হালকা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
পুলিশ মুছলেখা নিয়ে ৮ তরুণ-তরুনীদের অভিভাবকদের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছে- বিএনপি নেতা এমনটি দাবি করলেও, পুলিশ তা অস্বীকার করেছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) সাইফুল ইসলাম সোমবার বলেন, বিয়ে দেয়া বা মুছলেখা দিয়ে ছাড়ার বিষয়ে পুলিশ কিছু জানে না। রিসোর্টে হামলার খবরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিলো। এসময় এলাকার মুরব্বীরা বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিলে পুলিশ সেখান থেকে চলে আসে।
তবে মোগলাবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান রোববার বলেছিল্বন, জনতা কয়েকজন তরুণ-তরুণীকে আটক করেছে এমন খবর শুনে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। কিন্তু স্থানীয়রা পরিবারের কাছে তাদের হস্তান্তর করেছেন বলে শুনেছি। তবে আমি বার বার তাদেরকে বলেছি আটককৃতদের আমাদের জিম্মায় দিয়ে দেন। আমরা প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক তাদের অভিভাবকের কাছে হস্তান্তর করবো। কিন্তু স্থানীয়রা তা শুনেন নি।
এ ব্যাপারে রিজেন্ট পার্ক রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হেলাল আহমদ বলেন, আমাদের রিসোর্টে পুলিশের নির্দেশনা মোতাবেক ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করে বিশ্রাম নিতে দেয়া হয়। রোববারও ছেলে এবং মেয়েরা আলাদাভাবে বিশ্রাম নেয়ার জন্য ভোটার আইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। হঠাৎ করে একদল যুবক রিসোর্টে ঢুকে ভাংচুর-লুটপাট চালায়। তারা আসবাবপত্রে অগ্নিসংযোগও করে। ম্যানেজারের রুম থেকে ছেলে-মেয়েদের ভোটার আইডি কার্ডের কপি ছিড়ে ফেলে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তারা ছেলেমেয়েদের আটক করে রিসোর্টের চাবি নিয়ে নেয়। এরপর আটককৃতদের তারা বিয়ে দিয়েছেন বলে শুনেছি।
তিনি বলেন, হামলায় রিসোর্টের ৩০-৪০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
প্রায় ১১ বছর ধরে রিসোর্ট পরিচালনা করছেন জানিয়ে মালিক হেলাল উদ্দিন বলেন, স্থানীয় বাসিন্দা পরিচয়ে বিভিন্ন আয়োজনে রিসোর্ট ভাড়া নিতেন কয়েকজন। কিন্তু টাকাপয়সা ঠিকমতো দিতেন না। ৫ আগস্টের পর রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার চাঁদা হিসেবে টাকা চাওয়া হয়েছে। চাঁদা দাবিকারীরা বলতেন, ‘আমরা ভালো ব্যবসা করছি, তাদের যাতে ব্যবসায় অংশীদার করি।’ চাঁদা দাবি করা ব্যক্তিরা রাজনৈতিক দলের কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলেরই। তবে ভবিষ্যতে ‘ঝামেলা এড়াতে’ তারা কোন দলের, সেটি বলতে চাননি তিনি।
এদিকে, এই ঘটনার পর রিসোর্টটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।