স্টাফ রিপোর্টার হারুন অর রশিদ: গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী রাজা বিরাটের হবিষ্যি ভক্ষণ মেলা আরম্ভ হয়েছে। প্রতিবছর বৈশাখ মাস জুড়ে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
রবিবার (২৭ এপ্রিল) বৈশাখ মাসের প্রথম রবিবার থেকে শুরু হওয়া এই মেলা চলবে মাসব্যাপী।
স্থানীয়রা জানান, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাস জুড়ে এই মেলা হয়। কিন্তু তখন আর যাত্রী মেলা হয় না, শুধু কাঠের মেলা চলে। ছোট বড় ব্যবসায়ীরা কাঠের তৈরি দরজা, খাট, জানালাসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র বিক্রি হয়। এই মেলা থেকেই আসবাবপত্র কিনে বড় বড় মিষ্টির হাড়ি নিয়ে নতুন মেয়ে জামাইয়ের বাড়ীতে পৌঁছে দেয়ার রীতি আদিকাল থেকে চলছে।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজাহার ইউনিয়নের রাজা বিরাট বাজারে এই মেলার অবস্থান। প্রাচীনকাল থেকে শুরু হওয়া রাজা বিরাট মেলা হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত পবিত্র তীর্থক্ষেত্র হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিবছর দেশবিদেশের ধর্মপ্রাণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই মেলায় আসেন। দূরদূরান্ত থেকে আসা তীর্থযাত্রীরা নতুন মাটির হাঁড়িতে ভাতের সাথে করলা ও আলু সিদ্ধ করে সবাই একসাথে শতবর্ষী বটগাছের নিচে বসে খেয়ে নতুন হাড়িটি সেখানে ভেঙ্গে ফেলেন।
মেলার দিন এভাবে শত শত হাঁড়ি-পাতিল ভাঙ্গা হলেও এলাকায় প্রচলিত রয়েছে পরদিন সকালে এই হাঁড়ি-পাতিলের কোন অবশিষ্ট অংশ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে প্রচলিত রয়েছে আলু-করলার সিদ্ধ ভাত খেলে যাদের বাবা-মা অথবা সে সকল আত্মীয় স্বজন প্রয়াত হয়েছেন তাদের আত্মার কল্যাণ হয়।
বিরাট নগরী হলো হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যান মহাভারতের বর্ণনায় যে রাজা বিরাট, তাঁর নামে। তিনি বিরাট বনে এক উচ্চভূমিতে রাজবাড়ী ও নগর স্থাপন করেন। তখন থেকে এই জায়গার নাম বিরাট নগরী। তিনি তাঁর রাজ্যে হাজার হাজার দিঘি-পুষ্করিণী খনন করে মাছ চাষ করতেন, তাই ‘মৎস্যরাজ বিরাট’ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। এখানের মন্দিরে রাজা বিরাট তাঁর স্ত্রী সুদেষ্ণা ও পঞ্চপাণ্ডবের মূর্তি রয়েছে। আরও রয়েছে শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম। এখানে প্রতিদিন নিয়ম করে তাদের পূজা হয়।
তবে পৌরনিক কাহিনীর বরাত দিয়ে রাজা বিরাট মদন মোহন জিউ বিগ্রহ মন্দিরের উপদেষ্টা বলাই চন্দ্র বর্ম বলেন, প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে পঞ্চপাণ্ডব অজ্ঞাত বাসের সময় বিরাট রাজার রাজ্যে অজন্ম বা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ কারণে অনাহারে অর্ধাহারে মানুষের জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়ে। সে সময় রাজ্যের অনেক প্রজা অনাহারে মারা যায়।
এমতাবস্থায় প্রজারা রাজা বিরাটের কাছে দেশত্যাগের অনুমতি প্রার্থনা করলে রাজা তখন রাজজ্যোতিষীর শরণাপন্ন হন। তখন জ্যোতিষী গণণা শেষে রাজাকে জানান দেশের প্রজাগণ যদি বিরাট রাজার মন্দিরের সামনে আতব চালের ভাতে আলু-করলা সিদ্ধ দিয়ে হবিষ্যি অন্ন খেলে ধীরে ধীরে এই অজন্ম বা দুর্ভিক্ষ কেটে যাবে।
রাজার কথা মত প্রজারা আলু-করলা সিদ্ধ দিয়ে আতব চালের ভাত রান্না করে খাওয়া শুরু করলে ক্রমেই রাজা বিরাট থেকে দুর্ভিক্ষ কেটে যায়। তারপর থেকে প্রতিবছর বৈশাখ মাসের প্রতি রবিবার হিন্দুসম্প্রদায়ের মানুষ রাজা বিরাটের এই মন্দিরের সামনে হবিষ্যি অন্ন খেয়ে আসছেন। আদিকাল থেকে সেই বিশ্বাসের প্রতি আস্থা রেখে রীতি মেনে করলা-আলু সিদ্ধ ভাত রান্না করে খেয়ে আসছে।