স্টাফ রিপোর্টার:
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দিনাজপুর সদরে একচ্ছত্র আধিপত্য চালিয়েছেন জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ ও দিনাজপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম এবং আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের চাচাতো ভাই মাতলুবুল মামুন। দিনাজপুর সদরের পাঁচকুড় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হলেও চাচাতো ভাইদের প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ ও তদবির বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, কোতয়ালী থানায় মামলা বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন। দিনাজপুরের বালুবাড়ীতে তাকে ও তার গ্যাংকে চাঁদা না দিয়ে কেউ বাড়ী বানাতে পারতো না। ঐতিহাসিক পাঁচ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসকের পতনের পর ফ্যাসিবাদের দোসরদের সরিয়ে দেয়া হলেও অদৃশ্য শক্তির বলে মাতলুবুল মামুন এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। হুইপ ইকবালুর রহিমের সাথে তিনিও গণহত্যা মামলার আসামী হওয়া সত্বেও জনসম্মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নিয়মিত স্কুলেও যাচ্ছেন। সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক, পুলিশ, প্রশাসন ও বিএনপি-জামায়াত নেতাদের নিজের কব্জায় নিয়েছেন তিনি। কেউ তার কিছুই করতে পারবে না। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে দিনাজপুর সদরের ভুক্তভোগী মানুষদের মধ্যে।
মাতলুবুল মামুনের অত্যাচারের শিকার হয়েছেন এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি ও দিনাজপুর সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা (ডিজেএডি) এর সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন চিস্তি। ভুক্তভোগী জানান, দুই বছর আগে তার পৈত্রিক বাড়ীর দেয়ালের সাথে লাগিয়ে এবং ৬২ বছর ধরে ব্যবহৃত বাড়ীর রাস্তার একটি অংশ দখল করে জোরপুর্বক বহুতল ভবন নির্মাণ শুরু করেন মাতলুবুল মামুন। যদিও বাড়ীর রাস্তাটি নির্বিঘ্ন রাখতে ১৯৬৯ সালে মাতলুবুল মামুনের বাবা আব্দুল জব্বার সরকার ও চাচা সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট এম আব্দুর রহিম সাংবাদিক হুমায়ুন চিস্তির বাবাকে স্ট্যাম্প পেপারে লিখিত দেন। নিজের জায়গা বাদ দিয়ে অন্যের জায়গা দেখিয়ে পৌরসভা থেকে অবৈধভাবে বাড়ীর নকশা পাশ করিয়েছেন মামুন। এ বিষয়ে অভিযোগ করা হলে দিনাজপুর পৌরসভা বিষয়টি তদন্ত করে নালিশি ভবনটির নির্মাণ অবৈধ ঘোষণা করে একাধিকবার নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেও মামুন তা কর্ণপাত করেননি। পৌরসভা কর্তৃপক্ষ উভয়পক্ষকে নিয়ে মিমাংসার চেষ্টা করলেও কোনকিছুকেই তোয়াক্কা করেননি মাতলুবুল মামুন। বরং ভরা সালিশে মেয়রসহ উপস্থিত এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সামনে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বার বার বলেন, দেশে এমন কোন আইন নেই যে তাকে থামাতে পারে। সাবেক হুইপ ইকবালুর রহিম ও সাবেক বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের কাছে সহযোগিতা চাইলে তারা সাহায্য তো করেনই নি বরং বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ হলে আদালতের কাছে যাও। আমাদের এ বিষয়ে জড়িও না। তাদের বাবা ও চাচার দেয়া দলিল দেখালে বলেন, এ বিষয়ে এখন আমাদের কিছু করার নেই। উপায়ন্তর না পেয়ে আদালতের স্মরণাপন্ন হন ভুক্তভোগীর পরিবার। সেখানেও হুইপ ও বিচারপতির দাপট দেখাতে কমতি করেননি তিনি। কোন বিচারক ন্যায়বিচার করতে চাইলেই তাকে বদলী করানো হয়। সাংবাদিক হুমায়ুন চিস্তি তখনকার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও আইন সচিব গোলাম সারওয়ারের সাথে একাধিকবার দেখা করলে শুধু ন্যায়বিচারের আশ্বাস পেয়েছেন, কিন্তু কোন প্রতিকার পাননি। উপরন্তু মামলা চলাকালীন মাতলুবুল মামুনের বউ জনসমক্ষে সাংবাদিক হুমায়ুন চিস্তির মেজো বোনকে মারধর করে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। ২০২৩ এর নভেম্বরে আদালতের নির্দেশে গণপূর্ত বিভাগের তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি দু’পক্ষের সার্ভেয়ার, পাড়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে নালিশি ভবনটির তদন্ত করেন এবং নালিশি ভবনটির নির্মাণ সম্পুর্নরুপে দেশীয় আইনের নিয়ম বহির্ভূত ও অবৈধ বলে কোর্টে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন। তদন্ত করেন ওই সময়ে দিনাজপুরে কর্মরত গণপুর্ত অধিদপ্তরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ইমরান আহমেদ, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হুসাইন মোহাম্মদ শাফী মন্ডল ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। তদন্ত রিপোর্টে মাতলুবুল মামুনের অনিয়মের ফিরিস্তি বেরিয়ে এলেও এখনো ভবন নির্মাণ বন্ধে আদালতের নিষেধাজ্ঞা পাননি ভুক্তভোগীরা। বর্তমানে আদালতের সমন থাকার পরও সাক্ষ্য দিতে গড়িমসি করছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। মার্চে সমন পাঠানো হলেও গত একমাসে তারা তা হাতে পাননি বলে জানান। তদন্ত কমিটির সদস্যদের একজন যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতার ছোটভাই। তিনি নিজেও ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। তারা বলছেন, বিষয়টি এখন দেখার দায়িত্ব দিনাজপুরের বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলীর, তাদের না।
এদিকে, আবারো বাড়ী নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন মাতলুবুল মামুন। সগর্বে বলে বেড়াচ্ছেন কেউ তার কিছুই করতে পারবেন না। আদালত, সমন্বয়ক, রাজনৈতিক নেতা সবাই তার দখলে। গত কয়েকদিন আগে মাতলুবুল মামুনের আরেক সহযোগী আব্দুস সালামের সহযোগিতায় সাংবাদিক হুমায়ুন চিস্তির পৈত্রিক বাড়ীতে কয়েকবার আগুন লাগানোর চেষ্টা করা হয়। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টা আওয়ামী লীগের সমর্থক বানিয়ে বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকি দেন তারা। এ বিষয়ে চুড়ান্তভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ওই পরিবারের লোকজন। সাংবাদিক হুমায়ুন চিস্তির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ঢাকায় থাকায় দিনাজপুরের পৈতৃক বাড়ী ও স্বজনদের নিয়ে উৎকন্ঠায় দিন কাটাতে হয়। প্রতিনিয়ত বাড়ীতে থাকা মা ও ছোটবোনের খোঁজ নিতে হয়। আক্ষেপ করে বলেন, এতবড় বিপ্লবে স্বৈরাচারের পতনের পরও তাদের দোসরদের অত্যাচারের মাত্রা কমেনি বরং বেড়েছে। দোসরদেরই এখন বেশি শক্তিশালী মনে হয়। এর সুষ্ঠু প্রতিকারের দাবি জানান তিনি। আক্ষেপ করে বলেন, দেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে এতবড় বিজয়ের পরও কিভাবে, কিসের জোরে আওয়ামী লীগের দোসর হত্যা মামলার আসামি হয়েও নির্ভয়ে বুক উঁচু করে অপকর্ম গুলো করে বেড়াচ্ছে? কিসের অজুহাতে, কোন দুর্বলতার কারণে প্রশাসন নীরব? আওয়ামীলীগকে অপকর্ম করা থেকে কি সত্যি সত্যিই থামানো গেছে ?? নাকি আদৌও কোনদিন থামানো যাবে?? হুইপ ইকবালুর রহিমের বাড়ি ভাঙচুর করে নিশ্চিহ্ন করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু মাতলুবুল মামুনের মতো আওয়ামী লীগের আগাছা, পাতি নেতাদের সমুলে উপড়ে ফেলতে না পারলে দেশ কলুষিতই থেকে যাবে।