বিকাল বার্তা ডেস্ক>>
প্রকৃতি কন্যা জাফলংয়ের (ইসিএ) আওতাভূক্ত এলাকায় হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনের হিড়িক চলছে। হাইকোর্টের আদেশ উপেক্ষা করে জাফলং নদীর তলদেশের ৫০ থেকে ৬০ ফুট গভীর থেকে তোলা হচ্ছে এসব পাথর। সরেজমিনে দেখা যায় শক্তিশালি ফোর, সিক্স, এইট, টেন সিলিন্ডার মেশিন ব্যবহার করে নদীর গভীর থেকে পাথর তোলার তান্ডব। শুধু তাই নয় জাফলং নদীর পাড়ও লন্ডভন্ড করে দিয়েছে অসাধু পাথর খেকোরা। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত কয়েকদিনে প্রায় ৫শ কোটি টাকার বালু পাথর লুটপাট করা হয়েছে।
একসময় বোমা মেশিনের তান্ডব ছিল জাফলং পাথর কোয়ারিতে। প্রায় দেড় যুগ আগের এই তান্ডবের ক্ষতচিহ্ন কিছুটা পূরণ হতে এক যুগ সময় লেগেছিলো। কিন্তু বর্তমানে পাথর লুটপাটের কারণে আবারও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি কণ্যা জাফলংয়ের পরিবেশ। স্থানীয়রা জানান, কয়েকমাস পূর্বে প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে পাথর লুট থেমে ছিলো। কিন্তু এখন আর এই অবস্থায় নেই।
প্রথমে হাত দিয়ে, পরে শ্যালো মেশিনসহ নানা মেশিন দিয়ে কোয়ারির উপরের অংশ লুট করা হচ্ছে। এখন আর উপরের অংশে বালু কিংবা পাথর নেই বললে চলে। এখন বোমা মেশিন দিয়ে বেপরোয়াভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে পাথর। বোমা মেশিনের তান্ডবে একসময় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল জাফলংয়ের বুক।
পাথর ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- বোমা মেশিনের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। এটি মাটির গভীর থেকে পাথর তুলে আনে। এতে করে গভীরে ক্ষত দেখা দেয়। এতে করে চোরাবালির সৃষ্টি হয়। জাফলংয়ের প্রকৃতিরও বিবর্তন ঘটে। ২০০৫ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এরকম তান্ডব দেখেছিলেন জাফলংবাসী। আরেক যন্ত্রদানবের নাম হচ্ছে এক্সেভেটর, এই এক্সেভেটর দিয়ে ৩০ ফুট পর্যন্ত গভীর খনন করা যায়।
বর্তমানে অন্তত ৫টি স্থানে এই মেশিন দিয়ে বড় বড় গর্ত করে পাথর লুট করা চলছে। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিরো পয়েন্টসহ গোটা কোয়ারির উপরিভাগে থাকা অন্তত দেড়শ’ কোটি টাকার পাথর মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে লুট করা হয়। পরবর্তীতে সেনা সদস্যদের হস্তক্ষেপে লুটপাট বন্ধ হয়েছিল। ওই সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমীক্ষা চালিয়ে বলা হয়েছিল প্রায় ১২৫ কোটি টাকা পাথর লুট করা হয়েছে। যে পাথরের কোনো ট্যাক্সই সরকার পায়নি। লুটের ঘটনায় পরিবেশ থেকে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় জেলা বিএনপি’র পদ স্থগিত নেতা রফিকুল ইসলাম শাহপরান, সেলিম জমিদারসহ তাদের সহযোগীদের আসামি করা হয়। একইসঙ্গে দলীয়ভাবে বিএনপি’র পক্ষ থেকেও পাথরখেকোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবু জাফলংয়ে পাথরখেকোরা পিছু হটেনি; বরং জাফলং কোয়ারিতে দ্বিগুণ গতিতে লুটপাট চলছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন- ৫ মাসে জাফলং কোয়ারি থেকে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার বালু ও পাথর লুট করা হয়েছে। এখন তার কোয়ারির উপরের অংশে বালু ও পাথর নেই। এক্সেভেটরের তিনদিনের তাণ্ডবে দুলালের দোকান, ছাদ মেম্বারের বাঁধ ও খলিলের ঘরের নিকটবর্তী স্থানে ৪-৫টি বিশাল আকৃতির গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। পাথর লুটপাট করতে ওই এলাকা এখন পুকুরে পরিণত হয়েছে।
সর্বশেষ বুধবার যখন গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন অভিযান শুরু করে তখন ওই এক্সেভেটরগুলো লুকিয়ে ফেলা হয়। তবে গত দুদিন ধরে রাতের আঁধারে ফোর সিলিন্ডার বোমা মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে।
রাজু ড্রাইভারের বাড়ির সামনে নয়াবস্তির হেলাল, সাবু, সুমন, আবুল ও শিবুলের নেতৃৃত্বে ৭-৮টি বোমা মেশিন ব্যবহার করা হয়। দু’রাতেই প্রায় কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জুমপাড়সহ আশপাশ এলাকার মানুষ। বোমা মেশিন রাত ১২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত চালানো হয়। এ কারণে বোমার শব্দে নয়াবস্তি, কান্দুবস্তির মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। জাফলং নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা প্রশাসনের।এখনো পুলিশ ও বিজিবি পুরোপরি সক্রিয় হতে পারেনি। গোয়াইনঘাট পুলিশের যারা জাফলংয়ে রয়েছেন তারাও সবকিছু না দেখার ভান করেন। পাথরখেকো চক্রের কাছে তারা অসহায় হয়ে পড়েন। প্রায় এক মাস আগে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন এক অভিযান চালিয়ে লুট করা বিপুল পরিমাণ পাথরসহ ৫০০টি নৌকা আটক করেছিল। পরে স্থানীয়রা সংঘবদ্ধ হয়ে নৌকাসহ ওই পাথরগুলো ছিনিয়ে নেয়।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের কর্মকর্তারা হামলার ভয়ে জাফলংয়ে অভিযান চালাতে যান না। প্রথম দিকে কয়েকটি অভিযান চালালে তারাও নীরব রয়েছেন। ফলে বাধা ছাড়াই জাফলং থেকে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার বালু ও পাথর লুট করা হয়েছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইদুল ইসলাম জানিয়েছেন, তার পক্ষ থেকে বুধবার কোয়ারিতে অভিযান চালানো হয়। এখন যেদিকে পাথর নিয়ে আসা হয় সেই স্থানে স্থায়ী ব্যারিকেড দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল। প্রশাসনের নিয়োজিত ঠিকাদাররা ব্যারিকেড নির্মাণ করতে গেলে তাদেরকে হুমকি-ধমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রশাসনের সব অংশ একসঙ্গে কাজ না করলে লুট ঠেকানো সম্ভব নয়। এখন দিনের বেলা অভিযানের ভয়ে সবাই নীরব থাকে। আর রাতের বেলা তারা লুটপাট চালায়। এ নিয়ে কী করা যায় সেটি নিয়ে তারা চিন্তা-ভাবনা করছেন বলে জানান।