লেখক: সাবরিনা মিষ্টি:
পাখিটির গায়ের রং ঘন নীল! বুকের কাছে ফিকে ছাই রং এর নরম পালক, এতটাই পেলব যে ছুঁয়ে দেখতে মন চায়,ঝকঝকে কালো চোখে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত করছে গর্বিত সৌন্দর্য উচ্ছাস ! এত সুন্দর পাখি আমি একবার অস্টেলিয়ার সিডনিতে দেখেছিলাম কিন্তু এমন নৈসর্গিক পরিবেশে এমন একটা পাখি যেন জীবনের চেয়েও বেশি জীবন্ত ! শত কষ্টের মাঝেও আরও কিছুদিন বাঁচতে ইচ্ছে করে! “এইটার মাংস মজা হইবনা, তবুও একবার টেরাই (try) কইরা দেখি!” তন্ময় হয়ে পাখিটি দেখছিলাম, হঠাৎ কানের কাছে এমন ভয়াবহ কথা শুনে তাকিয়ে দেখি ভানু বিবি! ভানুবিবি বহু বছরের পুরানো কয়েদী – কত বছর ধরে আছেন, তার নিজেরও হিসেব নেই! কারাগারের সব্জীর বাগানের সে ইনচারজ! তাই তার কাছে চালতা গাছের চালতা পারার জন্য লম্বা বাঁশের লাঠির মাথায় কাপড়ের পুটুলির মতো একটি জিনিস আছে! সে দৌড়ে সেটা আনতে গেল-“বড় চৌকার( বড় রান্নাঘর) চুলায় পুইড়া আজ পাখির গোস খামু!”পাখিটি বুদ্ধিমান,ভানু খালাকে বাঁশের লাঠি নিয়ে আসতে দেখেই উড়ে এত উঁচু ডালে গিয়ে বসলো যে, নাগাল পাওয়া অসম্ভব ! উনি পাখির উদ্দেশ্যে বিড় বিড় করে কুৎসিত একটা গালি দিলেন! আমি বললাম, “এত সুন্দর একটা পাখিকে আপনি মারতে চান? খেতে চান? “ভানুবিবি তার শত বলিরেখা পরা মুখে খ্যাকখ্যাক করে হাসে, তোবড়ানো গালে একটা পান ঠেসে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে, “ভইন গো, সোনদর যখন ছটফটায়,তরপায় তখন সেরাম মজা হয়- হেইটা পক্ষী হউক বা মানুষ হউক!” ভানু খালার বাড়ি ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চলে-সেখানে ধান চালের বিশাল বড় সব আড়ত ছিল আর প্রচুর কেনাবেচা চলতো! ঐখানেই তিনি একটি পতিতালয় পরিচালনা করতেন-প্রথম অবস্থায় সে আর তার ছোট-বোন এটি শুরু করে -তখন মাত্র তিন ঘর ছিল, পরে বিভিন্ন বয়সের প্রায় একুশ বাইশ টি রমনী এখানে থাকা শুরু করে! ভানু খালা নিজে অবিবাহিত, ছোটবেলায় উনুন থেকে ছুটে আসা খড় দিয়ে মুখের একপাশ পুড়ে এতটাই ভয়ংকর দর্শন হয়েছে যে, এই পর্যন্ত কোন পুরুষ নিকষ কালো অন্ধকার ঘরেও তার সাথে শুতে রাজী হইনি! এতে তার এখন আর তেমন কোন ক্ষোভ বা দু:খ নাই, বেড়ার ফাঁক দিয়ে তার চালার মেয়েদের মাথামাখি আর রমনের পুরো দৃশ্যটাই সে দেখে – তার বড় ভালো লাগে! ভোগ না করতে পারলেও উপভোগের মজাটা নিতে সে ছাড়েনা! অন্য নারীদের মতো স্বামীর সন্তুষ্ঠি অর্জন আর বাচ্চাপালনে সময় আর খাটুনি দিতে হয়না বলে পুরো সময়টা সে ব্যবসায় দিতে পারে! তার আশ্রয়ে যে কয়টি মেয়ে আছে সবাই সুন্দরী-ভানু মনে করে, ব্যাটারা মুখে যতই ফটফটাক-শুইতে গেলে সোনদর খোঁজে! যারা মেয়ের সন্ধান নিয়ে আসে তাদের সে স্পষ্ট বলে দেয়,”ঘটকালি খুইলা বইনাই যে বিয়া দিমু, গুনবতীর খাওন নাই – রূপবতী যুবতী লাগব! সোনদর যোবতী আনবা, কমিশন ভালা পাইবা!” বিজনেস পলিসি হিসেবে এলাকার মাস্তান আর থানার সাহেবদের সে সবসময় খুশী রাখে! অল্প বয়সী সুন্দর মেয়ে পেলেই সে প্রথম তাদেরকেই খবর দেয়! এখানকার কোন মেয়ে পালানোর চেষ্টা করলে এরাই আবার ধরে নিয়ে আসে,যদিও, তেমন চেষ্টা খুব কম মেয়েই করে! পালিয়ে কই যাবে? সংসার আর সমাজের দরজা অনেক আগেই তো বন্ধ হয়ে গেছে! ভাটি অঞ্চল ছাড়িয়েও “ভানুবিবির চালা”র পরিচিতি ছড়িয়ে পরে বহুদূর পর্যন্ত !
ভানু কখনই চালা ছেড়ে বের হতোনা! থানার কনস্টেবলকে আর এলাকার মাস্তান নান্দাইল খালেককে বখরার টাকা পৌছাতে ছোট বোন রানুই সবসময় যায়! একদিন কনস্টেবলের বাড়ি গিয়ে রানু হাঁক দেয়, “ছোট সাব, ভানু বু পেটি পাঠাইসে! “ভাইজান বাড়িতে নাই , বলতে বলতে ছোটসাবের চৌদ্দ বছর বয়সী ছোট-বোন ইয়াসমিন বের হয়ে আসে ! রানুর সাথে তার আগেও দেখা হয়েছে ! রানুর কাছে ভানুচালার গল্প শোনে ইয়াসমিন, সেখানকার মেয়েরা কেমন করে সাজে, কেমন করে কথা বলে, কেমন মধুর করে হাসে,কেমন করে গান গায়, কেমন করে প্রেম করে, কেমন করে পুরুষের মন জয় করে ! ইয়াসমিনের যা বয়স সে বয়সে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকে- নৈতিকতার পাঠ সেখানে সিলেবাস বহির্ভূত ! রানুর কাছে গল্প শুনতে ইয়াসমিনের ভীষন ভাল লাগে বিশেষ করে শারিরীক অংশগুলো সে বারবার শোনে- শুনতে শুনতে চলে যায় এক ফ্যানটাসির জগতে ! আমাকে একবার নিয়ে যাবি রানু বুজি ভানু চালায়? “কস কি, ছোটসাব মাইরা ফালাইব, আমগো ব্যবসা বন্ধ কইরা দিব, তুই কি আমগো পেটে লাথথি মারতে চাস? “না বু’জি, বোরখা পিনদা যামু, কিছু হইবনা! সামনের সপ্তাহে ভাইজান সদরে যাইব -আমারে লইয়া যাইও! পরের সপ্তাহে সত্যি সত্যি বোরখা আর নেকাবে মুখ ঢেকে ইয়াসমিন ভানুচালায় হাজির।অবাক বিস্ময়ে সে চেয়ে চেয়ে দেখে সাজানো, গোছানো ঘরগুলো, রেডিওতে গান বাজছে, বাসি বকুলফুলের মালার গন্ধ চারিদিকে, পিতলের মোমদানিতে গত রাতের গলা মোম, বেশিরভাগ মেয়েই গতরাতের ক্লান্তি পোষাতে ঘুমে বেহুঁশ! দেখতে দেখতে থ মেরে যায় ইয়াসমিন-ঘোমটা খসে পরে! ভানুর কামরায় ইয়াসমিনকে নিয়ে আসে রানু, ভানু তখন ব্যবসা বিষয়ে নান্দাইল খালেকের এক শাগরেদের সাথে আলাপ করছিল! ইয়াসমিনকে দেখে চমকে উঠে দুজনই ! এ তো সাক্ষাত পরী! এরে ব্যবসায় লাগাতে পারলে প্রচুর কামাই হইব! রানু ইয়াসমিনকে নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে আসার পর সেই রাতে মনের ইচ্ছের কথা রানুকে জানায় সে! “কস কি বু? কনস্টেবলের আপন ভইন! রানু ভয়ে সিটিয়ে যায়! “কত বাপে আপন মেয়ে বেইচা দিয়া গেল, আর তুই কস – আপন ভইন”! হে এতদিন ধইরা যাগো কষ্টের ইনকামের টাকা চুইসা খাইতাসে, তারা কারও ভইন লাগে না??” পুড়ে যাওয়া মুখে একটা বিভৎস ভেংচি কেটে বলে ভানু। পরিকল্পনা অনুসারে পরদিন ইয়াসমিনকে আবারও ভানুচালায় নিয়ে আসে রানু! একটি ঘরে তাকে বসিয়ে পানি খেয়ে আসার অজুহাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় রানু! আর তখনি ঘরে ঢোকে নান্দাইল খালেক আর তার চাচা জাহাংগীর।আতংকে চিৎকার দিতেও ভুলে যায় ইয়াসমিন ! সংঘটিত হয় আদিমতম অপরাধ- বারবার ! বেড়ার ফাঁক দিয়ে পুরো দৃশ্যটি দেখে ভানু- একটি কোমল পুতুল কেমন করে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, ক্ষতবিক্ষত , রক্তাক্ত হচ্ছে -তার বড় আমোদ লাগে- বড় সুখ!
বিপুল রক্তক্ষরনে মারা যায় ইয়াসমিন, কোন চিকিৎসা ছাড়াই ! ভানুচালা থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক পরিত্যক্ত পুকুর পাড়ে তিন দিন পর তার লাশ