মোঃ মামুন আলী ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধি : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় এক সময়ের আপরিহার্য শিল্প “কামার শিল্প”। সময় ও চাহিদার বিবর্তনের সাথে সাথে এক সময়ের সেই অপরিহার্য কামার শিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। হয়তো আর কিছুকাল পর নতুন প্রজন্মের কাছে এটি কেবলই স্মৃতি হয়ে থাকবে। কামার একটি অতি প্রাচীন পেশা,যাদের কাজ লোহার জিনিসপত্র তৈরি করা। কামাররা পেশাগতভাবে গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার্য লৌহজাত সামগ্রী তৈরি করেন। অতি প্রাচীনকালে কেবল হিন্দু সমাজের শূদ্র সস্প্রদায় কামার পেশায় জড়িত ছিল কিন্তু আজকাল গ্রামাঞ্চলে কামার পেশার সাথে মুসলমানরাও জড়িত। আগেকার দিনে অধিকাংশ ঘরবাড়ি এবং কৃষি-যন্ত্রপাতি কামারদের দ্বারা তৈরি হতো। সেই সময় গ্রামের একটি নির্দিষ্ট পাড়ায় থাকতো কামারপাড়া। কামারপাড়ায় প্রবেশ করলেই চোঁখে পড়তো লোহার কারিগরদের লোহা দিয়ে বানানো নানান দ্রব্যসামগ্রী, লোহা পেটানোর কর্কশ শব্দ, লোহা পোড়া গন্ধ, পোড়া লোহা থেকে বিচ্ছুরিত আগুনের স্ফুলিঙ্গ। বর্তমান আধুনিক যুগে অনেক কিছুই বদলে গেছে। নিত্য ব্যবহার্য উপকরণ ব্যবহারে শহরাঞ্চলে নতুনত্বের ছোঁয়া লাগলেও গ্রামাঞ্চলে লোহার তৈরি বিভিন্ন উপকরণের ব্যবহার এখনো কমেনি। কারণ কৃষি থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজে প্রতিনিয়ত লোহার উপকরণের প্রয়োজন হয়। কৃষি কাজে কোদাল, লাঙ্গল, কাচি, শাবল, নিড়ানি আর সাংসারিক কাজে দা, বটি, খুন্তি, কুড়াল, চাকু ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। তবে উপকরণ ব্যবহারে পরিবর্তন না এলেও পরিবর্তন এসেছে পেশাজীবীদের মধ্যে। আগে যারা লোহার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাঁদের এই কাজ এখন বন্ধপ্রায়। কারণ শিল্পায়নের ফলে আধুনিক মেশিন বা যন্ত্র ব্যবহার করে এখন সেই লোহার উপকরণ তৈরি করা যায়। কামারেরা সাধারণত নিচু করে বানানো এমন ছোট্ট চালা ঘরগুলোতে কাজ করে। এগুলোকে ঘর বললে ভুল হবে, শুধু চাল আছে কিন্তু চারদিক খোলা। এই খোলা জায়গায় বসেই কামরারা সেই কাক ডাকা ভোর হতে রাত অবধি ব্যস্ততম সময় পার করেন। হাঁপড় দিয়ে উৎতপ্ত কয়লাতে বাতাস দেওয়া হয়। কয়লাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে হাঁপড়ে বাতাস দেওয়া হলে উৎতপ্ত কয়লা আরও ক্রমাগত উৎতপ্ত হয়। আর সেই উৎতপ্ত আগুনের মধ্যে লোহাকে রেখে গলানো হয়। লোহা যখন পুড়ে লাল হয়ে যায় তখন হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে চাহিদা মতো আকৃতি দেয়া হয়। মাঝে মাঝে জল ছিটিয়ে ঠান্ডা করে নেয়া হয়। কামারের হাতের যাদুতে চোঁখের পলকে লোহা হয়ে যায়- দা, কুড়াল, খুন্তি, কাচি সহ আরও কত কিছু। কামারদের কাজের প্রধান উপকরণ হলো লোহা আর কয়লা। এগুলো তাঁদের কিনতে হয়। কামাররা সপ্তাহের সাত দিনই ব্যস্ত থাকে লোহা পিটাতে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেকেই নানা রকম জিনিসের বায়না দিয়ে যায়। দা, বটি, কাচি, কুড়াল আর কোদালের বায়না আসে সবচেয়ে বেশি। কারণ গ্রামের মানুষেরা সাধারণত এই জিনিসগুলোই বেশি ব্যবহার করে। ধান কাটার মৌসুমে কাজের চাপ বেশি থাকায় ভাত খাবার সময়টুকুও হয় না তাঁদের। এর কারণ হলো এ সময়ে কাঁচি বা কাস্তের চাহিদা থাকে অন্য যেকোন সময়ের চাইতে বেশি। কামাররা ফরমায়েশি কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিছু জিনিস তৈরি করে জমা করে রাখেন। তাতে ক্রেতাদের অতিরিক্ত চাহিদা মেটানো যায়। এবং বিভিন্ন হাট থেকে আসা পাইকারদের নিকটও এগুলো বিক্রি করে।