মাহবুব ইসলাম ,হোমনা(কুমিল্লা) প্রতিনিধি:
কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামে তৈরী হচ্ছে আগুনে পুড়িয়ে বাঁশের বাঁশি,যা কিনা এশিয়া মহাদেশে বাঁশের বাঁশি তৈরীর সর্ববৃহত স্থান।
বৈশাখ মাস আসলে বাঁশি তৈরীর কারিগররা ব্যস্ত হয়ে পড়েন বাঁশি তৈরীতে।
গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবারেরও বেশি মানুষ বাঁশি শিল্পের সাথে জড়িত হয়ে পাল্টে দিয়েছে গ্রামের দৃশ্যপট। একমাত্র বাঁশি তৈরী করে এখানকার অনেকেই এখন স্বাবলম্বী।
কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার সদর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে শ্রীমদ্দি গ্রামটির অবস্থান। বাঁশি তৈরী করার মাধ্যমে স্বচ্ছল জীবন যাবন করছে এই গ্রামের অনেক পরিবার ।
শুধু তাই নয়, এখান থেকে বছরে প্রায় কোটি টাকার বাঁশি বিদেশে রফতানী হচ্ছে। শ্রীমদ্দি পুরো গ্রামটি ঘুরে চোখে পড়েনি বেকার কোন যুবক-যুবতীর দুঃখময় চেহারা। প্রতিটি বাড়ীর আঙ্গিনা ও অলিগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের বাঁশি। নারী-পুরুষ শিশুসহ সব বয়সের মানুষই বাঁশি শিল্পের বিভিন্ন ডিজাইন তৈরী করতে নিয়োজিত। গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর পাশাপাশি তাদের সন্তানেরাও পিছিয়ে নেই। প্রত্যেকে নিজ কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় অনুযায়ী বাঁশি তৈরী করছেন। এভাবে কাটছে শ্রীমদ্দি গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের জীবণধারা। এখান থেকেই বিভিন্ন ডিজাইনের বাঁশি চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় মার্কেটগুলেতে।
শ্রীমদ্দি গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ল একজন বাড়ির উঠানে বসে বাঁশি তৈরীতে ব্যস্ত। তবে তার কাছেই এলাকার বাঁশি শিল্পের কাজ সম্পর্কে পাওয়া গেলো নানান তথ্য। তার নাম অঙ্গদ চন্দ্র সরকার তিনি জানালেন বাঁশি শিল্পের নানান কথা।
তাদের গ্রামে বাঁশি তৈরীর কাজ শুরু হয়েছে সে থেকে এই বাঁশি শিল্পের সাথে তিনি জড়িত। তিনি বলেন আমাদের পূর্ব পুরুষ এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এই শিল্পের সাথে জড়িত । তাছাড়া এ কাজ তুলনামূলক ভাবে খুবই সহজ।
ফাল্গুন মাস থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত অধিক বাঁশি তৈরী ও বিক্রি হলেও শ্রীমদ্দি গ্রামের শিল্পীরা সারা বছরই বাঁশি তৈরী করে।
শ্রীমদ্দি গ্রামের আরেক বাঁশি তৈরীকারক যতীন্দ্র বিকাশ জানালেন, আমরা চট্রগ্রাম, ফটিকছড়ি, সীতাকুন্ড, মিরাসরাই থেকে মুলি বাঁশ কিনে ট্রাক যোগে নিয়ে আসি শ্রীমদ্দি গ্রামে। পরে বিভিন্ন মাপ অনুযায়ী মুলি বাশঁ কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। এরপর টুকরোগুলো রোদে শুকিয়ে ফিনিস করে লোহা কয়লা দ্বারা গরম করে মাপ অনুযায়ী বাঁশে ছিদ্র করা হয় এবং মান্দাল কাঠ দিয়ে বডি তৈরী করে বাঁশের মাথায় আটকিয়ে দেওয়া হয় এবং বাঁশের কভারে রং দ্বারা বিভিন্ন ডিজাইন করে বাজারজাত করা হয়।
বাঁশি শিল্লীদের তৈরী প্রতিপিস মোহনা বাঁশি ১৫ টাকা, আর বাঁশি ২০টাকা, মুখ বাঁশি ৮ টাকা, নাগিনী বাঁশি ১০ টাকা, ক্যালেনের বাঁশি ১২ টাকা, পাখী বাঁশি ২০টাকা, সোহন বাঁশি ১৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে। তবে লম্বা, মোটা নিঁখুত কাজের ওপর বাঁশির দাম নির্ভর করে। কিন্তু বাচ্চাদের মুখবাঁশি তৈরী ও বিক্রি হয় বেশি।
শ্রীমদ্দি গ্রামের যতীন্দ্র এর স্ত্রী রিণা বিকাশ নকশী করা বাঁশি তৈরী করেন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলেই নকশী করা বাঁশি তৈরী করে বিভিন্ন এনজিও এক্সপোর্টের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, বৃটেন, জাপান, কানাডা, জার্মান, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করে বলে তারা জানায়।
দশম শ্রেণী পাস করার পর বিয়ে হয়ে যায় রিণার, আর স্বামীর বাড়িতে এসেই শিখে নেয় বাঁশি তৈরীর কাজ। তারপর থেকেই শুরু করে নকশী করা বাঁশি তৈরী করা। রিণা ৩ সন্তানের জননী। সারাক্ষণ গৃহ ও বাঁশি তৈরীর কাজে ব্যস্ত থাকেন। তবুও তার মুখে হাসি।
বাংলাদেশের অনুষ্ঠিতব্য সকল বৈশাখী মেলায় শ্রীমদ্দির বাঁশের বাঁশি বিক্রি করা হয়।
বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের বৈশাখী মেলা ছাড়াও হোমনার বাউল বাড়ির মেলা ,মিরাশের মেলা, শ্রীমদ্দি কালীবাড়ীর মেলা, কচুয়ার সাচারের রথ মেলা, ধামরাইয়ের রথমেলা, মতলবের বেলতুলীর লেংটার মেলা, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার খরমপুরের মেলা, চট্রগ্রামের জব্বারের বলি খেলা, নাঙ্গলবব্দের অষ্টমী , সাতক্ষীরার পূজার মেলা, কুষ্টিয়া, গাজীপুরের মৌসুমী মেলায় বাঁশি বিক্রি ছাড়াও প্রায় সাড়া বছরই দেশের শহর, বন্দর, হাট- বাজারে তারা তাদের বাঁশি বিক্রয় করে থাকে।
বাঁশি শিল্পী আবদুল খালেক জানান, পূর্বে ১ হাজার ২শ’ টাকা ৮০টি কাউন বাঁশের মূল্য ছিল ,বর্তমানে ২ বছর যাবত ৮০ পিছ কাউন বাঁশের মূল্য ২ হাজার টাকারও বেশি। এবং রং, কয়লা ও স্প্রিটসহ বাঁশি তৈরীর সকল উপকণের দামই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাঁশি ২ বছর পূর্বে যে দাম ছিল চলতি বছরেও একই দাম। এ নিয়ে তারা দু:খ প্রকাশ করেন।
১লা বৈশাখ সহ গ্রাম বাংলার মেলায় বাঁশি বিক্রির জন্য এখন বাঁশি তৈরীতে নিয়োজিত রয়েছেন বাঁশি তৈরির কারিগররা।
এ বছর বৈশাখী মেলা সহ বিভিন্ন মেলায় তাদের তৈরী প্রচুর বাঁশের বাঁশি বিক্রি হবে এমনটাই আশা প্রকাশ করছেন তারা।